|| ড. কানাই লাল রায় ||
বৈদিক যুগের শারদোৎসব বা রুদ্রযজ্ঞ, সিন্ধু উপত্যকায় আবিস্কৃত প্রাগৈতিহাসিক যুগের বহু পোড়ামাটির স্ত্রী মূর্তি প্রভৃতি দুর্গাপূজার প্রাচীনত্বের পরিচায়ক। ছান্দোগ্য উপনিষদ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, মার্কণ্ডেয়পুরাণ, কালিকাপুরাণ, দেবীভাগবত, কালিবিলাসতন্ত্র প্রভৃতি পুরাণতন্ত্র গ্রন্থে কোথাও কোথাও কিছুটা রূপকাশ্রিত হলেও প্রায় ধারাবাহিকভাবে দুর্গাপূজার কথা জানা যায়।
বাঙালি হিন্দুর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বৃহৎ জাতীয় উৎসব দুর্গাপূজা। আদিতে চৈত্র মাস তথা বসন্তকালে দুর্গাপূজা হতো, যা ‘বাসন্তীপূজা’ নামে খ্যাত। তবে শরৎকালে অনুষ্ঠিত শারদীয় দুর্গাপূজাই অধিক জনপ্রিয়।
মার্কণ্ডেয়পুরাণ অনুযায়ী প্রকৃতপক্ষে রাজা সুরথই প্রথম বাংলাদেশে দুর্গাপূজা করেছিলেন। গবেষকদের মতে, সুরথের রাজধানী বলিপুর হলো বর্তমান বোলপুর। তবে বাংলায় সর্বপ্রথম সাড়ম্বরে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন সম্রাট আকবরের আমলে বাংলার বারভূঁইয়ার অন্যতম রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ। কথিত আছে, রাজা কংসনারায়ণ কুলপুরোহিত পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রীর কাছে অশ্বমেধ যজ্ঞ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। কিন্তু রমেশ শাস্ত্রী তাকে বলেছিলেন, কলিযুগে অশ্বমেধ যজ্ঞ প্রশস্ত নয়, বরং তিনি সাড়ম্বরে দুর্গাপূজা করুন। দুর্গাপূজায় অশ্বমেধ যজ্ঞেরই ফললাভ হবে। তার পরামর্শ অনুযায়ী রাজা কংসনারায়ণ এই শারদীয় দুর্গোৎসবে তখনকার দিনে সাড়ে আট লাখ টাকা ব্যয় করেছিলেন। তার দেখাদেখি ভাদুড়িয়ার জমিদার জগৎনারায়ণ ওই বছরই বসন্তকালে বাসন্তী দুর্গোৎসব করেছিলেন ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে। কিন্তু তার পূজা কংসনারায়ণের অনুরূপ জনপ্রিয়তা পায়নি।
তাহিরপুরের কংসনারায়ণের রাজবাড়ি রাজশাহী থেকে ৪০ কিলোমিটারের মতো দূরে। বাসে যাওয়া যায়। রাজবাড়ি ও দুর্গামন্দির স্বাভাবিক কারণেই পূর্বাবস্থায় নেই। বর্তমানে রাজবাড়িকে কিছুটা সংস্কার করে কলেজ করা হয়েছে। দুর্গামন্দিরটিও অনেক সংস্কার করা হয়েছে। তবে দুর্গাপূজার ধারাবাহিকতাটি চলে আসছে। আগে মাটির দুর্গাপ্রতিমায় পূজা করা হতো। ২০১৮ সাল থেকে সেখানে অষ্টধাতুর দুর্গাপ্রতিমা স্থাপন করা হয়েছে। এই সুদৃশ্য দুর্গাপ্রতিমা দর্শনের জন্য প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে বহু দর্শকের সমাগম হয়। বর্তমানে এখানে নিত্যপূজার ব্যবস্থা হয়েছে এবং একজন স্থায়ী পুরোহিত নিযুক্ত আছেন।
এ প্রসঙ্গে আরও বলা যায়, বাংলায় দেবী দুর্গার যে মূর্তিটি সচরাচর দেখা যায়, সেটি পরিবারসমন্বিতা বা সপরিবার দুর্গার মূর্তি। এই মূর্তির মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও মহিষাসুরমর্দিনী; তার ডান পাশে ওপরে দেবী লক্ষ্মী ও নিচে গণেশ, বাঁ পাশে ওপরে সরস্বতী ও নিচে কার্তিকেয়। কলকাতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার ১৬১০ সালে এই সপরিবার দুর্গার প্রচলন করেন। তারা কার্তিকেয়র রূপ দেন জমিদারপুত্রের, ইতোপূর্বে যা ছিল সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের আদলে যুদ্ধের দেবতারূপে কল্পিত। কলকাতায় কোনো কোনো বাড়িতে দুর্গোৎসবে লক্ষ্মী ও গণেশকে সরস্বতী ও কার্তিকেয়র সঙ্গে স্থান বিনিময় করতে দেখা যায়। এগুলো ছাড়াও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গার বিভিন্ন রকমের স্বতন্ত্র মূর্তি চোখে পড়ে। তবে দুর্গার রূপকল্পনা বা কাঠামোবিন্যাসে যতই বৈচিত্র্য থাকুক, বাংলায় দুর্গোৎসবে প্রায় সর্বত্রই দুর্গা সপরিবারে পূজিত হন।
দুর্গাপূজার সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিকটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। জীবনে অশুভ অসুর শক্তির বিনাশ করে শুভ সুর শক্তির প্রতিষ্ঠা দুর্গাপূজার শাশ্বত দর্শন। দুর্গাপূজা জাতীয় মহা আলোড়ন সৃষ্টিকারী ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এতে জড়িত হয় সর্বস্তরের মানুষ। ব্রাহ্মণ, প্রতিমা প্রণেতা, মালী, কুম্ভকার, তন্তুবায়, নরসুন্দর, বাদ্যকর, ঋষিদাস প্রভৃতি সর্ববর্ণের সর্বস্তরের মানুষের সহায়তা ও মিলন প্রয়োজন হয় দুর্গাপূজায়। বহু বিস্তৃত উদার ব্যাপক অনুভূতি জাগে এই পূজায়। বাস্তবিকই ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নীচ, ব্রাহ্মণ-শূদ্র এমনকি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের মহামিলনের ক্ষেত্র এই দুর্গাপূজা। এর ফলে সামাজিক বন্ধন যেমন দৃঢ় হয়, মানুষ অর্থনৈতিক দিক দিয়েও নানাভাবে উপকৃত হয় এই দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে।
দশভুজা দুর্গার কাঠামোতে দেশ ও জাতির সংহতি সাধনের স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। দুর্গা প্রতিমায় লক্ষ্মী ধনের, সরস্বতী জ্ঞানের, কার্তিক বীরত্বের, গণেশ সাফল্যের প্রতীক, আর দুর্গার দশটি হাত আর দশটি প্রহরণ (অস্ত্র) অপরিমেয় বলবীর্যের প্রতীক। সিংহ বশ্যতার প্রতীক আর মহিষাসুর সমস্ত অশুভের প্রতীক। একটি বলিষ্ঠ জাতি সমস্ত অশুভকে দলিত করে পরিপূর্ণতা লাভ করে। দেবী দুর্গার আরাধনাকে কেন্দ্র করে আমাদের মনেও এই ধারণাই দৃঢ় হয়। আমাদের দেশে দুর্গাপূজার উৎসবে অংশগ্রহণ করেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ। রাজনৈতিক ও গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ পূজামণ্ডপ দর্শন ও শুভেচ্ছাজ্ঞাপন করেন। বুদ্ধিজীবীরা ভাষণ দেন; শিল্পীরা সংগীত, নাটক প্রভৃতি পরিবেশন করেন। দুর্গাপূজা উপলক্ষে বেতার-টেলিভিশনে প্রচার হয় নানা অনুষ্ঠান, পত্রপত্রিকার বিশেষ সংখ্যা বা ক্রোড়পত্র। দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রকাশিত হয় বিশেষ স্মরণিকা। এর দ্বারা শিল্প-সাহিত্যের চর্চা হয়, সংস্কৃতি বিকশিত হয়। দুর্গাপূজার প্রতিমা নির্মাণ, পূজামণ্ডপ ও তোরণ নির্মাণ, আলোকসজ্জা, আলপনা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পের বিকাশ ঘটে। বলা বাহুল্য, এর সঙ্গে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়টি তো যুক্ত আছেই।
দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, সামাজিক মিলন উৎসবও বটে। এ পূজার সময় সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জনকল্যাণের জন্যই দুর্গাপূজা। জাতির ঐহিক ও পারত্রিক তথা সামগ্রিক কল্যাণই দুর্গাপূজার মূল লক্ষ্য।
লেখকঃ ড. কানাই লাল রায়, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়