।। নিউজ ডেস্ক ।।
১৬ ডিসেম্বর (শনিবার) বাঙালি জাতির চিরদিনের গৌরব, অসমসাহস, বীরত্ব, আত্মদান ও হাজার বছরের শৌর্যবীর্যের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন মহান বিজয় দিবস আজ। স্বাধীনতা লাভের ৫২ বছর পেরিয়ে ৫৩তে পদার্পণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ভূখণ্ড দেশ হিসেবে জানান দেয়ার দিন আজ। একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এই দিনে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মরণপণ যুদ্ধের শেষে পাকিস্তানি হানাদার বর্বর ঘাতক সেনাবাহিনী অবনত মস্তকে অস্ত্র নামিয়ে রেখে গ্লানিময় আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল বীর বাঙালি। প্রতিবছর এই দিনে জাতির মাঝে সমস্বরে একটি ধ্বনি যেন নতুন বার্তা ছড়িয়ে দেয় ‘জয়বাংলা’ বাংলার জয়, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল। মহান বিজয় দিবসের এই দিনে আপন সত্ত্বা যেন খুঁজে পায় রক্তক্ষয়ী বীর বাঙালি।
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সাল থেকে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চে গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক সেনাদের আত্মসমর্পণ ও বাংলাদেশের অগণিত মানুষের আত্মত্যাগ আর সীমাহীন কষ্টের প্রহর কেটে নতুন সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য এবং বীরত্বগাঁথা ইতিহাসের এই দিনটি উদযাপনের জন্য সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। একটি লালসবুজ পতাকা উড়নোর পাশাপাশি যথাযথ মর্যাদায় পালনের ঐতিহ্য অনুযায়ী আজ প্রভাতে ৩১টি তোপ ধ্বনির মধ্যদিয়ে শুরু হবে জাতীয় স্মৃতিসৌধে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা নিবেদনের পালা। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে মুক্ত হওয়ার পর বাঙালি জাতির ওপর নতুন রূপে শোষক হিসেবে আবির্ভূত হয় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী। তৎকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানিরা আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেও সেই বাংলার জনগণকে আবার পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে ধরতে হয়। পশ্চিম পাকিস্তানিদের নানা কৃতিকর্ম, হটকারিতা, অদূরদর্শিতা এবং অবিমৃশ্যকারিতার মধ্য দিয়ে দুই অঞ্চলের মধ্যে এক বৈষম্যের বেড়াজাল তৈরি হয়। দিনে দিনে পশ্চিম শাসকগোষ্ঠীদের অত্যাচার আর অবহেলা চরম আকার ধারণ করলে প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ হতে তুলে নেয় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষেরা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নেয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভকারী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে টালবাহনা শুরু করে পশ্চিম শাসকগোষ্ঠী।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে বাংলার শোষিত বঞ্চিত মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে বুটের তলায় স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য বর্বর এক অপারেশনে নামে পশ্চিম পাকবাহিনী। তৎকালীন পাকিস্তানি বাহিনী শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ ছেড়ে সমাধানের উপায় হিসেবে বন্দুকের নল আর কামানের গোলা বেছে নেয় এবং যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় পুরো বাঙালি জাতির ওপরে। এরই ধারাবাহিকতায় সামরিক শাসকগোষ্ঠী নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করায় মেতে ওঠে অস্ত্রের জোরে। শুরু হয়ে যায় মুক্তির লড়াই মহান মুক্তিযুদ্ধ।
এরপরই চূড়ান্ত হয়ে যায় আমাদের পৃথক পথচলার যাত্রা। ওদের সাথে আর নয়। ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় চূড়ান্ত লড়াই। দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিসংগ্রামের পর পরাজয় মেনে নেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ১৯৭১ সালের আজকের দিনে রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ৯১ হাজার ৪৯৮ জন নিয়মিত-অনিয়মিত এবং আধা সামরিক সৈন্য নিয়ে ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেন সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে। পৃথিবীর মানচিত্রে সার্বভৌম নতুন জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।